স্বপ্নাবিষ্ট অবস্থা থেকে
জেগে উঠার আগমুহূর্তে নিজেকে আবিষ্কার করলাম অদ্ভুত এক কক্ষে। দেয়ালের একপাশের তাক
পূর্ণ হয়ে আছে ছোট ছোট কার্ড ভর্তি অসংখ্য ফাইলে। এ ছাড়া রুমটির আর বিশেষ কোন
বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ল না। লাইব্রেরীর কার্ডগুলো যেমন লেখক বা বিষয়ের নামের বর্ণানুক্রম
অনুসারে সাজানো থাকে এ কার্ডগুলো ও তেমনিভাবে সাজানো ছিল। কিন্তু, মেঝে থেকে সিলিং পর্যন্ত
বিস্তৃত অগণিত এ ফাইলগুলো ছিল একটু ভিন্ন শিরোনামে! দেয়ালের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময়
প্রথম যে ফাইলটি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে তা ছিল ‘যাদের আমি পছন্দ করতাম’। এটি খুলে আমি কার্ডগুলোর ওপর
চোখ বুলাতে লাগলাম। তৎক্ষণাৎ এটি বন্ধ করে দিলাম যখন ভয়ের সাথে লক্ষ্য করলাম যে
কার্ডের ওপর লেখা প্রত্যেকটি নামই আমার পরিচিত। আর তখন কোনরূপ বলে দেয়া ছাড়াই
বুঝতে পারলাম যে, প্রকৃতপক্ষে আমি কোথায়? প্রাণহীন এই কক্ষের
অসংখ্য ছোট খোপে সাজানো আমারই কৃতকর্মের নথি। প্রতিটি মুহুর্তের কাজ হউক তা ছোট
কিংবা বড় সবই এখানে বিস্তারিতভাবে লিপিবদ্ধ। আমার স্মৃতি যেন আমার নিজের সাথেই
বিশ্বাসঘাতকতা করলো। প্রবল আগ্রহ আর ভয়ের মিশ্র এক অনুভূতি আমায় জেঁকে ধরলো যখন
আমি একটার পর একটা কাগজ খুলছিলাম। কিছু স্মৃতি ছিল সত্যিই সুখের, কিন্তু বেশীরভাগই এত
লজ্জা আর পরিতাপের যে আমি বারবার ঘাড় বাঁকিয়ে দেখছিলাম কেউ আসছে কি না?
‘বন্ধু’ শিরোনামের একটি ফাইলের
দিকে চোখ গেলো যার পাশেই পড়ে ছিলো ‘বন্ধু, যাদের আমি ঠকিয়েছি’ নামের আর একটি ফাইল। শিরোনামগুলোর
বিষয়বস্তু পার্থিব ছোটখাট ব্যাপার থেকে শুরু করে অপার্থিব ভয়, চিন্তা পর্যন্ত বিস্তৃত
ছিল। ‘আমার পড়া যত বই’, ‘যত
মিথ্যা আমি বলেছি’, ‘যেসব নিয়ামত আমি ভোগ করেছি’, ‘কৌতুক, বিদ্রুপ যা নিয়ে আমি
হেসেছি’। প্রত্যেকটি বিষয়ই এতো নিখুঁত ছিল যে, কিছু কিছু লেখার
যথার্থতায় এতো কষ্টের মাঝেও আমার হাসি পাচ্ছিলো; ‘ছোট বোনকে কী বলেছি’। কিন্তু আমি সত্যিই হাসতে পারছিলাম না যখন দেখছিলাম ‘রাগের মাথায় আমি কী করেছি’, ‘বাবা-
মার কথায় মনে মনে যা বিড়বিড় করেছি’। এগুলো আমার বিস্ময় বাড়িয়ে
তুলছিলো। অনেকক্ষেত্রেই তা ছিল প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। আবার অনেক সময় কম। আমি অবাক
বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলাম আমার পঁচিশ বছরের জীবনে এত হাজার হাজার এমনকি লক্ষ
লক্ষ কার্ড লেখা কি করে সম্ভব হল! অথচ এর প্রত্যেকটিতেই আমার স্বাক্ষরসম্বলিত
হাতের লেখা।
‘আমার শোনা যত গান’ এই শিরোনামের
ফাইলটি যখন আমি হাতে নিলাম তখন সত্যিই এর ওজন দেখে শঙ্কিত বোধ করলাম। অসংখ্য কার্ড
দিয়ে পূর্ণ কয়েক ফুট প্রস্থের এই ফাইলটির আমি যেন কোন কিনারা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সীমাহীন
লজ্জায় আমি ফাইলটি বন্ধ করে দিলাম শুধুমাত্র যে গানের মান দেখে তা নয় বরং জীবনের
কতটা সময় আমি গান শুনে ব্যয় করেছি তা ভেবে।
এর পরের ফাইলটা দেখে আমার মেরুদণ্ডের ভেতর দিয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেলো।
'আমার যত অশ্লীল
চিন্তা' শিরোনামের এই নথিটির সাইজ পরিমাপের কোন ইচ্ছাই আমার ছিলো না। ইঞ্চিখানেক ফাঁক
করার পর যে কার্ডটা আমার হাতে এসে পড়লো আমার ভীতবিহবল শূন্য দৃষ্টি তাতে হারিয়ে
গেলো। ভেতরটা কেমন যেন হাহাকার করে উঠলো। এরকম একটা তুচ্ছ মুহুর্তের কথাও এখানে
সংরক্ষিত আছে? হঠাত পাশবিক উন্মত্ততা আমায় পেয়ে বসলো। একটাই চিন্তা আমার মাথায় ঘুরপাক
খেতে লাগলো।
নাহ! এই কার্ডগুলো কেউ কখনো দেখতে পাবে না, এমনকি অদ্ভুত এই
রুমের হদিসও যেন কেউ না পায়। এর সবই আমাকে ধ্বংস করতে হবে।
একটা পাগলাটে অবস্থার মধ্যে আমি ফাইলগুলো টেনে বের করতে লাগলাম। এগুলোর
আয়তন এখন আর আমার কাছে কোন ব্যাপারই মনে হল না। আমাকে পুড়ে ফেলতে হবে এসব নথি।
কিন্তু যখনই আমি এগুলো টেনে মাটিতে ফেলতে চাইলাম, আমি ব্যর্থ হলাম।
মরিয়া হয়ে অবশেষে কার্ডগুলো ছিঁড়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলাম। কিন্তু, হায়! এগুলোকে মনে
হলো ষ্টীলের চেয়েও শক্ত।
অসহায় আর পরাজিত আমি একটা সময় সব আশা ছেড়ে দিলাম। দেয়ালে যখন পিঠ এসে
ঠেকলো তখন আমার দীর্ঘশ্বাসে বাতাস ভারী হয়ে আসছিলো। হঠাত আমি এটা দেখলাম। 'ইসলামের আলো
পৌঁছেছিলাম যাদের কাছে' এই শিরোনামের একটি ফাইল যার প্রচ্ছদটি
প্রায় নতুন। দেখে মনে হচ্ছে এর ব্যবহার খুব একটা হয়নি। এটা খোলার পর যে অল্প
কয়েকটা কার্ড এসে আমার হাতে পড়লো তার সংখ্যা আমি সহজেই গুনতে পারলাম।
বুক ফেটে আমার কান্না বেরিয়ে আসতে চাইল। কী করুণ আর্তি সে কান্নার! আমার
অশ্রুপূর্ন দু'চোখের সামনে শুধু ফাইলভর্তি তাকগুলো ভাসছিলো। আর অসহায় হৃদয়ের আর্তি
ছাপিয়ে উঠলো সবকিছুকেই
'হায়! সত্যিই যদি আমার জীবনে এসব না থাকতো,
হায়! সত্যিই যদি আমার জীবনে এসব না থাকতো!'
"আমি মৃতকে করি জীবিত এবং লিখে রাখি যা
তারা অগ্রে প্রেরণ করে এবং যা তারা পশ্চাতে রেখে যায়।"১
“হে নাবী! তুমি বলে দাও : তোমরা কাজ করতে থাক, অনন্তর তোমাদের
কার্যকে অচিরেই দেখে নিবেন আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও
ঈমানদারগণ; আর নিশ্চয় তোমাদেরকে প্রত্যাবর্তিত হতে
হবে এমন এক সত্তার নিকট যিনি হচ্ছেন সকল অদৃশ্য ও প্রকাশ্য বিষয়ের জ্ঞাতা, অতঃপর তিনি তোমাদেরকে
তোমাদের সকল কৃতকর্ম জানিয়ে দেবেন।” ২
পাদটীকা :
গল্পটি Islamic stories নামের একটি অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ থেকে অনূদিত।
[১] আল
কুর'আন ৩৬
: ১২
[২] আল
কুর'আন ৯ :
১০৫