সোমবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৫

অনিবার্য যাত্রার প্রাক্কালে

সুউচ্চ চূড়া থেকে অতল গহ্বরে
দিকভ্রান্ত আলোহীন বদ্ধ পাঁজরে,
কেবল পতনের শব্দ শুনি
নিকটেই খসে পড়া নক্ষত্রের মতোন।
তবু জমাটবদ্ধ মুহূর্তদের অবিরাম গলে যাওয়া,
শেষ টুকরার অপেক্ষায়।    
জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি সমাপ্তি শুধু
কিছু পথের,
কিছু বখে যাওয়া দিন
আর স্মৃতি হয়ে থাকা কিছু নিউরনের।
অনন্ত ব্যাপ্ত সে পথের তরে
বড় তুচ্ছ এ রসদ।



বৃহস্পতিবার, ৮ অক্টোবর, ২০১৫

কবিতার প্রহর ১৭

নিশান- বরদার

ফররুখ আহমদ


দিন রাত্রির বোঝা হ'ল আজ দুঃসহ গুরুভার,
স্খলিত পথীর আয়োজন চলে পশ্চাৎ যাত্রার,
চারদিকে বন মরণ শর্তে জীবনের অধিকার_
এখানে তোমার নিশান ওড়াও হে নিশান বরদার!

তোমার নিশান উড়ছে কোথায় নির্জন প্রান্তরে,
জনারণ্যের এখানে শুণ্য শাখা,
নীড় ছেড়ে তার স্বপ্নের পাখী বহুদিন পলাতকা 
জরাস্থবির তার সুদূরের পাখা
মাটিতে গুমরি মরে_
ভেঙে পড়ে বার বার
হে নিশান বরদার!

চারদিকে কারা ফেলে বিষাক্ত শ্বাস,
কারা বয়ে আনে করোটিতে মৃতাসব,
শবের মিছিলে ভিড় ক'রে আসে শব;
মুখ বয়ে আনে চরম সর্বনাশ।

সে পাশবতার আজ উদ্যত ফণা
বিষাক্ত করে সুদূর সম্ভাবনা,
ভেঙে পড়ে তার পুচ্ছ আঘাতে স্বপ্নের চারাগাছ,
লাত মানাতের সঙ্গে নাচে পিশাচ
আধো জীবন্ত তনু;
রং চটা তার আকাশে কখন নিভেছে বর্ন ধনু।

সে সিদরাতুল- মুনতাহার 
পথ ভোলা বুলবুলি,
প্রতি মুহুর্তে আবিল করে সে
এই ধরণীর ধুলি,
ম্লান জুলমাতে আজ সে বিবর গড়ি'
দীপ্ত দিনেরে ক'রেছে কখন বিষাদ শর্বরী।
তার কণ্ঠের বীভৎস চীৎকারে_
কেঁপে উঠে বারে বারে
উষর মাটির বক্ষে অনুর্বর
দুঃস্বপ্নের ঘর।

শঙ্কিত তার দিনের আকাশ,
বিভীষিকা ভরা ঘুম,
ছিন্ন ডেরার দু'য়ারে আঘাত
হানে মরু সাইমুম,
তার কলিজার রক্তে রঙিন গড়ে উঠে ইমারত,
তার কঙ্কাল বিছায়ে জালিম মাপে মিনারের পথ;
পথে পথে আজ শোনো তার হাহাকার
হে নিশান বরদার!

এখানে তোমার নিশান ওড়াও, নিশান ওড়াও বীর,
এখানে শুধুই আবছায়া রাত্রির
তিমির নিবিড়তর,
এখানে তোমার সূর্য প্রকাশ করো।
জনারণ্যের শাখায় শাখায় জাগে প্রাণ- ব্যাকুলতা
আনো আনো তার বিপুল তৃষার দুকূলে উচ্ছলতা
সমুদ্র স্রোতোধার;
হে নিশান বরদার।।

~ ঈষৎ সংক্ষেপিত 

রবিবার, ২৬ জুলাই, ২০১৫

টুকরো জীবন ৩

এইতো সেদিন,
কাকভেজা খুব বৃষ্টি হলে
ছুটে যেতাম কদমতলে।
নুয়ে পড়া সবক'টা ফুল
এই বুঝি পাই হাত বাড়ালে।
ইচ্ছেগুলো অব্যক্ত রয়
হারিয়ে যায় কোন অতলে।
জল ছুঁয়ে যায় নোনা জলে।

ফিরে যেতাম ছোট্ট নীড়ে,
সিক্ত বিকেল শান্ত হলে
থাক না জীবন, এই ক'টা দিন
কাটিয়ে দেই হাসির ছলে।

 

টুকরো জীবন ২

নিশ্চুপ ফুটপাতে
হেঁটে চলা চুপচাপ,
চঞ্চল বৃষ্টিরা
ঝরছে যে টুপটাপ।

ঐ দূর জানালায়
স্বপ্ন কেউ এঁকে যায়,
এথা সুখ থেমে যায়
নিরুপায় যাত্রায়।


সোমবার, ২৫ মে, ২০১৫

কবিতার প্রহর ১৬

বাজিছে দামামা বাঁধরে আমামা

কাজী নজরুল ইসলাম


বাজিছে দামামা বাঁধরে আমামা
শির উঁচু করি মুসলমান।
দাওয়াত এসেছে নয়া যমানার
ভাঙ্গা কেল্লায় ওড়ে নিশান।।

মুখেতে কালেমা হাতে তলোয়ার,
বুকে ইসলামী জোশ দুর্বার,
হৃদয়ে লইয়া এশক আল্লাহর
চল আগে চল বাজে বিষান।
ভয় নাই তর গলায় তাবিজ
বাঁধা যে রে তোর পাক কোরান।।

নহি মোরা জীব ভোগ- বিলাসের,
শাহাদাত ছিল কাম্য মোদের,
ভিখারির সাজে খলীফা যাদের
শাসন করিল আধা জাহান-
তারা আজ পড়ে ঘুমায়ে বেহুঁশ
বাহিরে বহিছে ঝড় তুফান।।

ঘুমাইয়া কাজা করেছি ফজর,
তখনো জাগিনি যখন যোহর,
হেলা ও খেলায় কেটেছে আসর
মাগরিবের আজ শুনি আজান।
জামাত শামিল হওরে এশাতে
এখনো জমাতে আছে স্থান।।

শুকনো রুটিকে সম্বল ক’রে
যে ঈমান আর যে প্রানের জোরে
ফিরেছে জগত মন্থন ক’রে
সে শক্তি আজ ফিরিয়ে আন।
আল্লাহ আকবর রবে পুনঃ
কাঁপুক বিশ্ব দূর বিমান।।
 

বুধবার, ৬ মে, ২০১৫

কবিতার প্রহর ১৫

এপিটাফ 

আল মাহমুদ

 

রক্তের উৎসধারা কারা আনে? কারা গায় আল্লাহর বিজয়?
ছবি কৃতজ্ঞতা : গুগল ইমেজ
আমার সালাম শুধু বলে দিও, বলো, নেই ভয়।
ভয় নেই, হে অক্ষয় অবিনাশী আত্মার পাখিরা
তোমাদের কলকণ্ঠে ছিঁড়ে যাবে আকাশের শিরা।
ভেঙে যাবে মেঘপুঞ্জ, খুলে যাবে নীলিমার খিল
পৃথিবীর দৃশ্য ছেড়ে শুরু হবে চিরঞ্জীব দৃশ্যের মিছিল।
সেখানেই বেঁচে থাকা, সেই শুরু গায়েবের ঘর
বিদ্যুৎ বিভায় হলো উদ্ভাসিত যাদের কবর।

আমরা পৃথিবীবাসী শুধু দেখি রক্ত আর ক্লেদ
বুঝি না মৃত্যুর ভাষা, সত্য আর মিথ্যার প্রভেদ।

শুক্রবার, ১ মে, ২০১৫

কিছু কথা অমলিন

জগদ্বিখ্যাত ফার্সি কবি শেখ সাদি (রহঃ) এঁর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সঞ্চারিত বাণী 'গুলিস্তাঁ' ও 'বুস্তাঁ' এ গ্রন্থ দু'টি যা বাংলা ভাষা সহ অনূদিত হয়েছে বিভিন্ন ভাষায়। বাংলা অনুবাদ পড়তে গিয়েই মাঝে মাঝে এর কথার গভীরতায় খেই হারিয়ে ফেলেছি। তারপরও মনে হয়েছে যদি মূল ভাষায় পড়তে পারতাম তাহলে হয়ত নান্দনিকতার আরেক রূপ দেখতে পেতাম!  অসংখ্য ভালোলাগার মাঝে দু-চার ছত্র।


- জ্ঞানীলোক তখনই কথা শুরু করে অথবা খাবারের মধ্যে হাত দেয়, যখন না বললে ক্ষতি হয় অথবা না খেলে মারা যায়। এভাবে তাদের কথা জ্ঞানপূর্ণ থাকে এবং খাদ্যে তার স্বাস্থ্যের জন্য উপকার হয়।

- বিরান জঙ্গল ও বালুময় ময়দানে পিপাসার্ত ব্যক্তির মুক্তা ও ঝিনুক দ্বারা কি উপকার হয়? তা থাকা আর না থাকা সমান। খাদ্যশুন্য ব্যক্তি যখন ক্ষুধায় ঢলে পড়ে, তখন কোমরে বাঁধা স্বর্ণ তার কি উপকারে আসে!

- যখন তুমি প্রতিযোগিতার আশংকা দেখো, তখন ধৈর্য অবলম্বন কর। কেননা নম্রতা প্রতিযোগিতা বন্ধ করে। নম্র ব্যবহার ও মিষ্টি ভাষায় একটি উগ্র হাতিকেও চুল দিয়ে বেঁধে রাখা যায়। অতএব, তুমি যেখানেই লড়াই দেখবে, নম্র ব্যবহার কর। কেননা, রেশম অতি নরম কিন্তু তা ধারালো অস্ত্র দ্বারা কাটা যায় না।

- কখনো বন্ধুর কাছে নিরাপদে বসবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত ঐ বন্ধুর অভ্যাস সম্পর্কে না জানবে। ঐ রকম শত্রুর দাঁতের জখম অত্যন্ত গভীর, যাকে দেখতে বন্ধুর মতো দেখায়।

- ঐ বন্ধুর সাক্ষাতে আমার কষ্ট হয়, যে আমার খারাপ স্বভাব কে ভালো বলে, আমার দোষসমূহকে বিজ্ঞতা বলে মনে করে এবং আমার কাঁটাগুলোকে গোলাপ-চামেলি বলে। কে এমন দুশমন আছে যে, আমাকে আমার দোষগুলো ধরে দেয়?

- দানের বৃক্ষ যেখানেই শিকড় বসায়, তার ডালপালা আসমান হতেও উপরে চলে যায়। তুমি যদি তা হতে ফল খেতে চাও, তবে কখনো দান করে ইহসান স্বরূপ করাত দিয়ে তার শিকড় কেটে দিও না। তোমাকে সম্পদ দান করে নেকী করার শক্তি দেয়া হয়েছে এজন্য যে, তুমি খোদার শোকর আদায় করো।   

রবিবার, ১৯ এপ্রিল, ২০১৫

কবিতার প্রহর ১৪

এই সব রাত্রি

ফররুখ আহমদ 


এই সব রাত্রি শুধু এক মনে কথা কহিবার
                             নিজেদের সাথে,
পুরানো যাত্রীর দল যারা আজি ধূলির অতিথি
                             দাঁড়ালো পশ্চাতে।

কায়খসরুর স্বপ্ন কঙ্কালের ব্যর্থ পরিহাস
জীবাণুর তনু পুষ্টি করিয়াছে কবে তার লাশ!
শাহরিয়ার দেখে যায় কামনার নিষ্ফল ব্যর্থতা,
জিঞ্জীরে আবদ্ধ এক জীবনের চরম রিক্ততা।

এই সব রাত্রি শুধু একমনে কথা কহিবার--
খরস্রোতা জীবনের কোল ঘেঁষে সেখানে অসাড়
অন্ধকার বালিয়াড়ি, তলদেশে যাত্রীরা নিশ্চল,
মৃত্যুর কুয়াশা মাঝে বিবর্ণ তুহিন তনুতল
আঘাতে সকল গান, সব কথা রিক্ত নিরুত্তাপ,
স'য়ে যায় কবরের, স'য়ে যায় ধূলির প্রতাপ,
এই সব রাত্রি শুধু একমনে সেই কথা শোনে,
সেতারা উড়িয়ে তার অন্ধকার দুরন্ত পবনে।

এই সব আঁধারের পানপাত্র, মর্মর নেকাব
ছাড়ায়ে হীরার কুচী, জ্বলিতেছে জুলেখার খা'ব,
লায়লির রঙিন শরাব। কেনানের ঝরোকার ধারে;
ঝরিয়ে রক্তিম চাঁদ আঁধারের বালিয়াড়ি পারে।

এই সব রাত্রি শুধু একমনে করে যায় ধ্যান,
আবার শুনিতে চায় কোহিতূর, সাফার আহবান
দূরচারী মুসাফির কাফেলার ঘণ্টার ধ্বনিতে
তারার আলোয় গ'লে মারোঁয়ার পাহাড়তলীতে
মৃদু- স্বপ্নে কথা ক'য়ে আবছায়া শুভ্রতা বিভোর,
এই সব ম্লান রাত্রি সূর্যালোকে হ'তে চায় ভোর।

শুক্রবার, ১০ এপ্রিল, ২০১৫

হে আল্লাহ্‌! আমাদের 'অল্প সংখ্যক' লোকের অন্তর্ভুক্ত করে দিন।

courtesy : freebigpictures.com
একবার উমার বিন খাত্তাব (রাঃ) বাজারের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় শুনতে পেলেন, এক লোক দু'আ করছে, ''হে আল্লাহ্‌! আমাদের অল্পসংখ্যক লোকের অন্তর্ভুক্ত করে নিন। আমাদের অল্পসংখ্যক লোকের অন্তর্ভুক্ত করে নিন।'' তিনি তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ''এ দু'আ তুমি কোথায় পেয়েছো?''
লোকটি জবাব দিল, ''আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা কুর'আনে বলেছেন, ''আমার বান্দাদের মাঝে অল্পসংখ্যক মানুষ ই কৃতজ্ঞ'' (কুর'আন ৩৪ : ১৩)
এ কথা শুনে উমার (রাঃ) কাঁদতে আরম্ভ করলেন। আর নিজেকে তিরস্কার করতে লাগলেন, "লোকেরা তোমার চেয়েও বেশি জ্ঞানী, হে উমার! হে আল্লাহ্‌, আমাদের অল্পকিছু লোকের অন্তর্ভুক্ত করে দিন।"

আপনি যখন কাউকে কোন খারাপ কাজ ত্যাগ করতে বলেন, তখন প্রায় সময়ই এই উত্তরটা পাওয়া যায়, ''শুধু তো আমি একা না, বেশীরভাগ লোকই এটা করছে!'' কিন্তু আমরা যদি কুর'আনে 'বেশীরভাগ মানুষ' কথাটি খুঁজি তাহলে দেখবো, 'বেশীরভাগ মানুষ'
'জানে না' (৭ : ১৮৭)
'ধন্যবাদ দেয় না' (২ : ২৪৩)
'বিশ্বাস করে না' (১১ : ১৭ )
অধিকাংশ মানুষ
'বেপরোয়াভাবে অবাধ্য' (৫ : ৫৯)
'অজ্ঞ' (৬ : ১১১)
'মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে' (২১ : ২৪)
'আল্লাহ্‌র আয়াত সমূহ ও সাক্ষাত অস্বীকার করে' (২৯ : ২৩)
'কিছুই শুনে না' (৮ : ২১)

তাই সে অল্পকিছু লোকদের মধ্যে থাকার চেষ্টা করুন যাদের সম্পর্কে আল্লাহ্‌ সুবহানাহু তা'আলা বলেছেন,
'আমার বান্দাদের মাঝে অল্পসংখ্যক লোকই শোকর আদায় করে' (৩৪ : ১৩)
'কম সংখ্যক মানুষ ই বিশ্বাস করেছে' (১১ : ৪০)
'থাকবে সেই পরিতৃপ্তির বাগানে, যারা (বড় অংশ) থাকবে পূর্ববর্তী লোকেদের মাঝ থেকে, আর সামান্য অংশ থাকবে পরবর্তীদের মধ্যে' (৫৬ : ১২-১৪)

ইবনুল কায়্যিম (রাহিঃ) বলেছেন, "সত্যের পথে এগিয়ে যেতে একাকীত্ব বোধ করোনা কারণ অল্পসংখ্যক লোকই এ পথ বেঁছে নিয়েছে। আর মিথ্যা পথের ব্যাপারে সতর্ক থেকো, এর অধিক সংখ্যক অনুসারী যেনো তোমাদের প্রতারিত করতে না পারে।"

- কিতাব আল- যুহদ

মূল লেখা : 'O Allah, Make us of Your 'Few' Servants' থেকে অনূদিত।

বুধবার, ৮ এপ্রিল, ২০১৫

টুকরো জীবন

পৃথিবীর সীমানা যেথায় শেষ,
সেথায় যেতে খুব ইচ্ছে হয় আজকাল।
তারপর এমনই কি কোন গ্রহ?
এমনই আত্মকেন্দ্রিক জনতার ঢল নামে ভোর হলে!
যাদের বিষাক্ত নিঃশ্বাসে বিবর্ণ হয়ে আছে
গাছের সবকটা সবুজ পাতা।

ভারী পাতা নেমে আসা দু'চোখে
সবুজ দেখতে বড্ড ইচ্ছে হয় আজকাল।








বুধবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

আহূতি

সকালের ক্লান্তিহীন ঝরে পড়া সোনারোদ,              
আর গর্তে লুকানো আমরা,
তবু চলে যাওয়া সময়ের স্মৃতি হতে চাইনি কেউই।
কী চেয়েছিলাম আর কী পেলাম,
সে হিসাবের কালি আজ ফিকে হয়ে এসেছে,
জীর্ণ কাগজ পড়ে আছে প্রৌঢ় ভাগাড়ে
হয়তবা জ্বালানী হয়েছে কোন লকলকে শিখার।
গাঢ় কুয়াশার অস্পষ্টতায়,
মানুষের স্বপ্ন পোড়া ধোঁয়া
চোখে জ্বালা ধরায়।
মৃত্যুর স্তব্ধতায় ভয়দ ঠেকে হৃদ স্পন্দন। 

হে অনাগত প্রজন্ম,
মৃত্যুর অগণন মিছিলে হেঁটে যাওয়া
আমাদের ভীরুতা আর কাপুরুষতা রেখে গেলাম তোমাদের তরে,
কালচে হয়ে যাওয়া সমাজের শরীরে।
হেলায় ফেলে যে পরশ পাথর
আমরা লুকালাম ইঁদুরের গর্তে,
তার ছোঁয়ায় সীসা-ঢালা প্রাচীরের মত দাঁড়িয়ে যাবে।
নষ্ট পৃথিবীকে তোমরা শুনাবে সে জাগরণের গান,
শাশ্বত সত্যের দিকে যার আহবান।

শুক্রবার, ৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

কবিতার প্রহর ১৩

উমর ফারুক

কাজী নজরুল ইসলাম


তিমির রাত্রি-'এশা'র আযান শুনি দূর মসজিদে।
প্রিয়-হারা কার কান্নার মতো এ-বুকে আসিয়া বিঁধে!

আমির-উল-মুমেনিন,
তোমার স্মৃতি যে আযানের ধ্বনি জানে না মুয়াজ্জিন।
তাকবীর শুনি, শয্যা ছাড়িয়া চকিতে উঠিয়া বসি,
বাতায়নে চাই-উঠিয়াছে কি-রে গগনে মরুর শশী?
ও-আযান, ও কি পাপিয়ার ডাক, ও কি চকোরীর গান?
মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে ও কি ও তোমারি সে আহবান?

আবার লুটায়ে পড়ি।
'সেদিন গিয়াছে'- শিয়রের কাছে কহিছে কালের ঘড়ি।
উমর! ফারুক! আখেরী নবীর ওগো দক্ষিন-বাহু!
আহবান নয়-রূপ ধরে এস- গ্রাসে অন্ধতা-রাহু!
ইসলাম- রবি, জ্যোতি তার আজ দিনে দিনে বিমলিন!
সত্যের আলো নিভিয়া- জ্বলিছে জোনাকির আলো ক্ষীণ।
শুধু অঙ্গুলি- হেলনে শাসন করিতে এ জগতের
দিয়াছিলে ফেলি মুহাম্মদের চরণে যে- শমশের
ফিরদৌস ছাড়ি নেমে এস তুমি সেই শমশের ধরি
আর একবার লোহিত সাগরে লালে- লাল হয়ে মরি!
ইসলাম- সে তো পরশ-মানিক তাকে কে পেয়েছে খুঁজি?
পরশে তাহার সোনা হল যারা তাদেরেই মোরা বুঝি।
আজ বুঝি- কেন বলিয়াছিলেন শেষ পয়গম্বর-
'মোরপরে যদি নবী হত কেউ, হত সে এক উমর।'
************************

অর্ধপৃথিবী করেছ শাসন ধূলার তখতে বসি
খেজুরপাতার প্রাসাদ তোমার বারে বারে গেছে খসি
সাইমুম- ঝড়ে। পড়েছে কুটির, তুমি পড়নি ক' নুয়ে,
উর্ধ্বের যারা- পড়ছে তাহারা, তুমি ছিলে খাঁড়া ভূঁয়ে।
শত প্রলোভন বিলাস বাসনা ঐশ্বর্যের মদ
করেছে সালাম দূর হতে সব ছুঁইতে পারেনি পদ।
সবারে উর্ধ্বে তুলিয়া ধরিয়া তুমি ছিলে সব নিচে,
বুকে করে সবে বেড়া করি পার, আপনি রহিল পিছে।

হেরি পশ্চাতে চাহি-
তুমি চলিয়াছ রৌদ্রদগ্ধ দূর মরুপথ বাহি
জেরুজালেমের কিল্লা যথায় আছে অবরোধ করি
বীর মুসলিম সেনাদল তবু বহু দিন মাস ধরি।
দুর্গের দ্বার খুলিবে তাহারা বলেছে শত্রু শেষে-
উমর যদি গো সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করে এসে!
হায় রে, আধেক ধরার মালিক আমির-উল-মুমেনিন
শুনে সে খবর একাকী উষ্ট্রে চলেছে বিরামহীন
সাহারা পারায়ে! ঝুলিতে দু খানা শুকনো 'খবুজ' রুটি
একটি মশকে একটুকু পানি খোর্মা দু তিন মুঠি।
প্রহরাবিহীন সম্রাট চলে একা পথে উটে চড়ি
চলেছে একটি মাত্র ভৃত্য উষ্ট্রের রশি ধরি! 
মরুর সূর্য ঊর্ধ্ব আকাশে আগুন বৃষ্টি করে,
সে আগুন-তাতে খই সম ফোটে বালুকা মরুর পরে।
কিছুদূর যেতে উট হতে নামি কহিল ভৃত্যে, 'ভাই
পেরেশান বড় হয়েছ চলিয়া! এইবার আমি যাই
উষ্ট্রের রশি ধরিয়া অগ্রে, তুমি উঠে বস উটে,
তপ্ত বালুতে চলি যে চরণে রক্ত উঠেছে ফুটে।'

ভৃত্য দস্ত চুমি
কাঁদিয়া কহিল, 'উমর! কেমনে এ আদেশ কর তুমি?
ঊষ্ট্রের পিঠে আরাম করিয়া গোলাম রহিবে বসি
আর হেঁটে যাবে খলিফা উমর ধরি সে উটের রশি?
                               খলিফা হাসিয়া বলে,
'তুমি জিতে গিয়ে বড় হতে চাও, ভাই রে, এমনি ছলে।
রোজ-কিয়ামতে আল্লাহ যে দিন কহিবে, 'উমর! ওরে
করেনি খলিফা, মুসলিম- জাঁহা তোর সুখ তরে তোরে।'
কি দিব জওয়াব। কি করিয়া মুখ দেখাব রসূলে ভাই।
আমি তোমাদের প্রতিনিধি শুধু, মোর অধিকার নাই।
আরাম সুখের, মানুষ হইয়া নিতে মানুষের সেবা।
ইসলাম বলে, সকলে সমান, কে বড় ক্ষুদ্র কে বা।

ভৃত্য চড়িল উটের পৃষ্ঠে উমর ধরিল রশি,
মানুষে স্বর্গে তুলিয়া ধরিয়া ধূলায় নামিল শশী।
*************************

তুমি নির্ভীক, এক খোদা ছাড়া করনি ক' কারে ভয়,
সত্যব্রত তোমায় তাইতে সবে উদ্ধত কয়।
মানুষ হইয়া মানুষের পূজা মানুষেরি অপমান,
তাই মহাবীর খালেদেরে তুমি পাঠাইলে ফরমান,
সিপাহ-সালারে ইঙ্গিতে তব করিলে মামুলি সেনা,
বিশ্ব-বিজয়ী বীরেরে শাসিতে এতটুকু টলিলে না।
**************************

মানব প্রেমিক! আজিকে তোমারে স্মরি,
মনে পড়ে তব মহত্ত্ব কথা- সেদিন সে বিভাবরী
নগর- ভ্রমণে বাহিরিয়া তুমি দেখিতে পাইলে দূরে
মায়েরে ঘিরিয়া ক্ষুধাতুর দুটি শিশু সকরুণ সুরে

কাঁদিতেছে আর দুখিনী মাতা ছেলেরে ভুলাতে হায়,
উনানে শূন্য হাঁড়ি চড়াইয়া কাঁদিয়া অকুলে চায়।
শুনিয়া সকল - কাঁদিতে কাঁদিতে ছুটে গেলে মদিনাতে
বায়তুল- মাল হইতে লইয়া ঘৃত আটা নিজ হাতে,
বলিলে, 'এসব চাপাইয়া দাও আমার পিঠের 'পরে,
আমি লয়ে যাব বহিয়া এ-সব দুখিনী মায়ের ঘরে।'
কত লোক আসি আপনি চাহিল বহিতে তোমার বোঝা,
বলিলে, 'বন্ধু, আমার এ ভার আমিই বহিব সোজা!
রোজ- কিয়ামতে কে বহিবে বল আমার পাপের ভার?
মম অপরাধে ক্ষুধায় শিশুরা কাঁদিয়াছে, আজি তার
প্রায়শ্চিত্ত করিব আপনি' - চলিলে নিশীথ রাতে
পৃষ্ঠে বহিয়া খাদ্যের বোঝা দুখিনীর আঙিনাতে!
                             এত যে কোমল প্রাণ,
করুণার বশে তবু গো ন্যায়ের করনি ক' অপমান!
মদ্যপানের অপরাধে প্রিয় পুত্ররে নিজ করে
মেরেছ দোররা, মরেছে পুত্র তোমার চোখের 'পরে!
ক্ষমা চাহিয়াছে পুত্র, বলেছ পাষাণে বক্ষ বাঁধি-
'অপরাধ করে তোরি মত স্বরে কাঁদিয়াছে অপরাধী।'

আবু শাহমার গোরে
কাঁদিতে যাইয়া ফিরিয়া আসি গো তোমারে সালাম করে।

খাস দরবার ভরিয়া গিয়াছে হাজার দেশের লোকে,
'কোথায় খলিফা' কেবলি প্রশ্ন ভাসে উৎসুক চোখে,
একটি মাত্র পিরান কাচিয়া শুকায়নি তাহা বলে,
রৌদ্রে ধরিয়া বসিয়া আছে গো খলিফা আঙিনা- তলে।
হে খলিফাতুল- মুসলেমিন! হে চীরধারী সম্রাট!
অপমান তব করিব না আজ করিয়া নান্দী পাঠ,
মানুষেরে তুমি বলেছ বন্ধু, বলিয়াছ ভাই, তাই
তোমারে এমন চোখের পানিতে স্মরি গো সর্বদাই।
                                             (সংক্ষেপিত)