বুধবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

কবিতার প্রহর ১১

এক আল্লাহ জিন্দাবাদ

কাজী নজরুল ইসলাম


উহারা প্রচার করুক হিংসা বিদ্বেষ আর নিন্দাবাদ;
আমরা বলিব সাম্য শান্তি এক আল্লাহ জিন্দাবাদ।
উহারা চাহুক সংকীর্ণতা, পায়রার খোপ, ডোবার ক্লেদ,
আমরা চাহিব উদার আকাশ, নিত্য আলোক, প্রেম অভেদ।

উহারা চাহুক দাসের জীবন, আমরা শহীদি দরজা চাই;
নিত্য মৃত্যু-ভীত ওরা, মোরা মৃত্যু কোথায় খুঁজে বেড়াই!
ওরা মরিবেনা, যুদ্ব বাধিঁলে ওরা লুকাইবে কচুবনে,
দন্তনখরহীন ওরা তবু কোলাহল করে অঙ্গনে।

ওরা নির্জীব; জিব নাড়ে তবু শুধূ স্বার্থ ও লোভবশে,
ওরা জিন, প্রেত, যজ্ঞ, উহারা লালসার পাঁকে মুখ ঘষে।
মোরা বাংলার নব যৌবন, মৃত্যুর সাথে সন্তরী,
উহাদের ভাবি মাছি পিপীলিকা, মারি না ক তাই দয়া করি।

মানুষের অনাগত কল্যাণে উহারা চির অবিশ্বাসী,
অবিশ্বাসীরাই শয়তানী-চেলা ভ্রান্ত-দ্রষ্টা ভুল-ভাষী।
ওরা বলে, হবে নাস্তিক সব মানুষ, করিবে হানাহানি।
মোরা বলি, হবে আস্তিক, হবে আল্লাহ মানুষে জানাজানি।

উহারা চাহুক অশান্তি; মোরা চাহিব ক্ষমাও প্রেম তাহার,
ভূতেরা চাহুক গোর ও শশ্মান, আমরা চাহিব গুলবাহার!
আজি পশ্চিম পৃথিবীতে তাঁর ভীষণ শাস্তি হেরি মানব
ফিরিবে ভোগের পথ ভয়ে, চাহিবে শান্তি কাম্য সব।

হুতুম প্যাঁচারা কহিছে কোটরে, হইবেনা আর সূর্যোদয়,
কাকে আর তাকে ঠোকরাইবেনা, হোক তার নখ চষ্ণু ক্ষয়।
বিশ্বাসী কভু বলেনা এ কথা, তারা আলো চায়, চাহে জ্যোতি;
তারা চাহে না ক এই উৎপীড়ন এই অশান্তি দূর্গতি।

তারা বলে, যদি প্রার্থনা মোরা করি তাঁর কাছে এক সাথে,
নিত্য ঈদের আনন্দ তিনি দিবেন ধুলির দুনিয়াতে।
সাত আসমান হতে তারা সাত-রঙা রামধনু আনিতে চায়,
আল্লা নিত্য মহাদানী প্রভূ, যে যাহা চায়, সে তাহা পায়।

যারা অশান্তি দুর্গতি চাহে, তারা তাই পাবে, দেখো রে ভাই,
উহারা চলুক উহাদের পথে, আমাদের পথে আমরা যাই।
ওরা চাহে রাক্ষসের রাজ্য, মোরা আল্লার রাজ্য চাই,
দ্বন্দ্ব-বিহীন আনন্দ-লীলা এই পৃথিবীতে হবে সদাই।

মোদের অভাব রবে না কিছুই, নিত্যপূর্ণ প্রভূ মোদের,
শকুন শিবার মত কাড়াকাড়ি করে শবে লয়ে-- শখ ওদের!
আল্লা রক্ষা করুন মোদেরে, ও পথে যেন না যাই কভূ,
নিত্য পরম-সুন্দর এক আল্লাহ্ আমাদের প্রভূ।

পৃথিবীতে যত মন্দ আছে তা ভালো হোক, ভালো হোক ভালো,
এই বিদ্বেষ-আঁধার দুনিয়া তাঁর প্রেমে আলো হোক, আলো।
সব মালিন্য দূর হয়ে যাক সব মানুষের মন হতে,
তাঁহার আলোক প্রতিভাত হোক এই ঘরে ঘরে পথে পথে।

দাঙ্গা বাঁধায়ে লুট করে যারা, তার লোভী, তারা গুন্ডাদল
তারা দেখিবেনা আল্লাহর পথ চিরনির্ভয় সুনির্মল।
ওরা নিশিদিন মন্দ চায়, ওরা নিশিদিন দ্বন্দ চায়,
ভূতেরা শ্রীহীন ছন্দ চায়, গলিত শবের গন্ধ চায়!

তাড়াবে এদের দেশ হতে মেরে আল্লার অনাগত সেনা,
এরাই বৈশ্য, ফসল শৈস্য লুটে খায়, এরা চির চেনা।
ওরা মাকড়সা, ওদের ঘরের ঘেরোয়াতে কভু যেয়ো না কেউ,
পর ঘরে থাকে জাল পেতে, ওরা দেখেনি প্রাণের সাগর ঢেউ।

বিশ্বাস করো এক আল্লাতে প্রতি নিঃশ্বাসে দিনে রাতে,
হবে দুলদুল - আসওয়ার পাবে আল্লার তলোয়ার হাতে।
আলস্য আর জড়তায় যারা ঘুমাইতে চাহে রাত্রিদিন,
তাহারা চাহে না চাঁদ ও সূর্য্য, তারা জড় জীব গ্লানি-মলিন।

নিত্য সজীব যৌবন যার, এস এস সেই নৌ-জোয়ান
সর্ব-ক্লৈব্য করিয়াছে দূর তোমাদেরই চির আত্বদান!
ওরা কাদা ছুড়ে বাঁধা দেবে ভাবে - ওদের অস্ত্র নিন্দাবাদ,
মোরা ফুল ছড়ে মারিব ওদের, বলিব - "এক আল্লাহ জিন্দাবাদ"।


সোমবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

বাতিঘর

কখনো ভরা আষাঢ়ের মধ্যাহ্নে
থমকে যাওয়া ঘড়ির কাঁটায়
হেঁটে আসি নিকট অতীতের অজানা সেই বালুকাবেলায়।
ঘনিয়ে আসে অন্ধকার,  
নীড়ে ফিরে গেছে দু’টো সারস।
কি দুর্বিষহ আঁধার এক,
আছড়ে পড়ে অব্যক্ত যন্ত্রণার শব্দ বুকে নিয়ে। 

মাঝ সমুদ্রে একটানা বেজে চলছে একটা সাইরেন।
চাপা পড়ে গেছে,   
গর্জনরত তরঙ্গের উদ্বাহু নৃত্যের কাছে
বুঝিবা কোন বন্দী পশুর ক্রোধ,
সুযোগ পেলেই ছিঁড়ে ফেলবে গোটা পৃথিবী।
পল পল করে পেরিয়ে যাচ্ছে সময়,
সম্মুখেই সে তরঙ্গের শীতল হাতছানি,
মনে হয় ধ্বংস অতি নিকটেই।
স্থির চোখ, পলকহীন, আর বয়ে চলা স্রোত সময়ের

কিন্তু না, হঠাৎ থেমে গেছে সাইরেন।
কার্টেসী : google
ঠাণ্ডা স্পর্শ বুকে নিয়ে লজ্জাবনত রাঙামুখো এ সূর্যকে
আমি যেন প্রথম দেখলাম।
শান্ত সমুদ্রের মায়াময় উষ্ণতা বয়ে নিয়ে যাওয়া সেই সিক্ত বাতাস,
বলে গেল চুপিচুপি,
এগিয়ে যাও, সামনে আরেকটু পথ।
তারপরেই সে বাতিঘর,
যে বাতিঘর কখনো নেভে না।।।
 

শনিবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

কবিতার প্রহর ১০

প্রার্থনার  ভাষা

আল মাহমুদ


মানুষের নভোযান, খেয়া আর প্রযুক্তি তাড়িত বিশাল যান্ত্রিক উৎক্ষেপ
সবি নিরর্থক স্বপ্নের জ্বালানিতে ব্যর্থতার সমুদ্রে সাঁতার মাত্র।
আমি চাই অন্য কিছু
আমার গতি তুমি তো জানো প্রভু কোন দিকে ধাবমান।
আমার রক্ত-মাংসে সেই ফেলে আসা চুম্বকের টান।
যেখান থেকে আমাদের পিতা-মাতা
কেবল জ্ঞানের লোভে, অমরতা ও আত্মতৃপ্তির আকাঙ্ক্ষায়
একদা কানাকড়ির মূল্যে হারিয়ে ছিলেন বেহেশত। সেই
মহাউদ্যানের টান আমার রক্তে, আমার মাংসে ও মজ্জায়।
দাও তাকে ফিরিয়ে আমায়।
প্রার্থনার ভাষা দাও প্রভু, নির্জ্ঞান আত্মসমর্পনের সহজতা।
আমি কি পাড়ি দিয়ে যাচ্ছি না হাঙরকুল সমুদ্রের চেয়ে দুরূহ
যে আয়ু?
সেই দিন এবং রাত্রি?
উদয় আর অস্ত।
আঁধার আর আলো। না
আলো আর অন্ধকার আর নয়। জ্বলুক তোমার নূরের দীপ্তি
যা ভেদ করে যায় পৃথিবীর উদরে লুকানো সমস্ত গলিত ধাতুর
                                                  সাতপরত পর্দা।
পৌঁছুতে চাই প্রভু তোমার সান্নিধ্যে
তোমার সিংহাসনের নীচে  একটি ফুরফুরে প্রজাপতি হয়ে।
যার পাখায় আঁকা অনাদিকালের অনন্ত রহস্য।