সোমবার, ২৭ অক্টোবর, ২০১৪

কড়া নেড়ে গেছি ভুল দরজায়

ছবি : গুগল
ছেলেটার একটানা চিৎকার অসহ্য ঠেকছিলো। একে তো লং জার্নি, তার উপর অপরিচিত এক জায়গায় এসে উঠেছি। সবচেয়ে বড় কথা দোতলার যে বাসাটায় আমরা উঠেছি তার ব্যালকনিতেই যেতে পারছি না। একটু দূরেই নিচে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। ৭-৮ বছরের একটা ছেলে অথচ গায়ে কোন কাপড়ই নেই। 
শেষমেশ বিরক্ত হয়ে আমার যে আত্মীয়ের বাসায় উঠেছি ওনাকে জিজ্ঞেসই করে ফেললাম। 'ছেলেটা কখন থেকে এভাবে দাঁড়িয়ে চিৎকার করছে! কেউ কিছু বলছে না কেন?' উনি বললেন, 'বলার মত কেউ নেই। ছেলেটা প্রতিবন্ধী। কথা বলতে পারে না। তাছাড়া গায়ে কাপড়ও রাখে না। আর সে ওখানে ইচ্ছে করে দাঁড়িয়ে আছে কই! তার মা সকালে গার্মেন্টস কারখানার কাজে যাওয়ার আগে তাকে ঐ খুঁটির সাথে তালা মেরে রেখে গেছে। সন্ধ্যায় ফিরে এলে তালা খুলে তাকে ভেতরে নিয়ে যাবে। জন্মের দু'বছর পরই ওর বাবা ওদের ফেলে রেখে চলে যায়। তারপর থেকে ওর মা ওকে এভাবেই বড় করছে।'
মুহুর্তের জন্য কোন কথা সরল না আমার মুখ থেকে। তারপর যে দু'দিন ছিলাম নিজের কাজ ছাড়া বাকীটা সময় ব্যালকনিতেই দাঁড়িয়ে থাকতাম। চারধারে দেয়ালের প্রাচীর। মাঝখানে ছোট ছোট তিনটা টিনের ঘর। এরই একটাতে ওরা থাকে। সকালে যাওয়ার আগে তার মা তাকে পরিষ্কার একটা কাপড় পরিয়ে দেয় (যদিও কিছুসময় পরেই সে তা খুলে ফেলে)। তারপর দেয়ালের এককোণের একটা কাঠের খুঁটির সাথে তাকে বেঁধে রেখে যায়। এক হাত লম্বা একটা শিকল। এটুকুই তার বিচরণক্ষেত্র। সাথে থাকে সস্তা কিছু চকোলেট।
সারাদিন সে অদ্ভুতভাবে চিৎকার করে। হয়তবা তার অব্যক্ত কথাগুলোই ফুটিয়ে চলে প্রাণপণে। এর মাঝে একবার শুরু হল ঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টির সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ছেলেটার চিৎকার। অনেকক্ষণ পর পাশের ঘর থেকে একজন মহিলা বের হয়ে তালা খুলে দিল। বৃষ্টি থামতেই আবার সেই বদ্ধতা।

এর মাঝে কিছু ব্যাপার লক্ষ্য করে অবাক হলাম। দেয়ালের গায়েই একটা ছোট ছিদ্র আছে যেটা তার জানা। একটু দূরেই রেললাইন হওয়ায় বেশ কয়েকটা ট্রেন যায় ঐ রাস্তা দিয়ে। ট্রেনের আওয়াজ শুনলেই ছেলেটা উঠে সেই ছিদ্রে চোখ রাখে। যতক্ষণ ট্রেনটা যায় হারিয়ে যাওয়ার এক আনন্দ যেন তার চোখে-মুখে ফুটে উঠে।
তবে সবচেয়ে আনন্দের সময়টা হচ্ছে বিকেলবেলা যখন দেয়ালের ওপাশের খালি জায়গায় তার বয়সী কয়েকটা ছেলে ক্রিকেট খেলতে আসে। প্রাচীরের ছিদ্র দিয়ে সারাটা খেলাই সে যে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুধু দেখে তা না বরং হাত পা ছুঁড়ে সেও যেন সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। প্রাচীরের ভেতরের এ খেলার নীরব দর্শক আমি। ছোট্ট এক ছিদ্রে সে যেন তার জীবনের সব রঙ খুঁজে পেয়েছে।
সন্ধ্যার পর তার মা আসলে সে ফিরে যায় প্রশান্তির নীড়ে।

ক্ষুদ্র এ জীবনে হতাশার কোন শেষ নেই। তুচ্ছ কারণেও অভিযোগের পাহাড় গড়ে উঠে। জীবনের রঙ খুঁজতে যতই দ্বারস্থ হই সাহিত্য, বিজ্ঞান কিংবা সংগীতের, আত্মার প্রকৃত প্রশান্তি থেকে ততই যেন দূরে সরে যাই। তাইত প্রাচীরের অসংখ্য ছিদ্রেও কখনো রঙিন জীবন ধরা পড়েনি। কারণ অগণিত নিয়ামত ভোগ করার পরও সে চোখ কৃতজ্ঞতার বর্ষণে সিক্ত হতে শেখেনি...   

২টি মন্তব্য:

  1. ক্ষুদ্র এ জীবনে হতাশার কোন শেষ নেই। তুচ্ছ কারণেও অভিযোগের পাহাড় গড়ে উঠে। জীবনের রঙ খুঁজতে যতই দ্বারস্থ হই সাহিত্য, বিজ্ঞান কিংবা সংগীতের, আত্মার প্রকৃত প্রশান্তি থেকে ততই যেন দূরে সরে যাই। তাইত প্রাচীরের অসংখ্য ছিদ্রেও কখনো রঙিন জীবন ধরা পড়েনি। কারণ অগণিত নিয়ামত ভোগ করার পরও সে চোখ কৃতজ্ঞতার বর্ষণে সিক্ত হতে শেখেনি...

    উত্তরমুছুন
  2. ঘুরে যাওয়ার জন্য ধন্যবাদ :)।

    উত্তরমুছুন