শুক্রবার, ৩১ অক্টোবর, ২০১৪

কবিতার প্রহর ১২

প্রহরান্তের পাশ ফেরা

আল মাহমুদ


আমি নৈঃশব্দের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে বালিশের ওপর
কাত হয়ে এ শহরের সর্বশেষ নিভু নিভু শব্দের মিলিয়ে যাওয়া
তরঙ্গ রক্তের ভেতর অনুভব করি। এমনকি শব্দের
ফেটে যাওয়া বুদবুদগুলিও বুঝি আমার কর্ণকুহরে
প্রবেশ করে। স্নায়ুতন্ত্রীতে বেজে উঠে ঢাকা শহরের
প্রতিটি প্রহরান্তের পাশ ফেরা। একটা বিনিদ্র পাগলের
পেছনে খেঁকিয়ে ডাকছে একপাল কুকুর। আর চির
জাগরূক রাজনীতি পোস্টার সেঁটে দিচ্ছে আগামী হরতালের।
নৈঃশব্দের জন্য অপেক্ষা মানে তো অভ্যস্ত আওয়াজ থেকে,
দিনের ঘড় ঘড় থেকে রাত্রির শিসের জন্য বসে থাকা।
দিনের কোলাহল তো মানুষের শরীরের মতো।
অনবরত শব্দের হাত পা নড়ছে। যেমন সকাল বেলা
মিহি শব্দে কসাইরা মাংসের চাঙড় ফালা ফালা করে ফেলে
আর আমাদের কানে বাজে মাংস ও লোহার সম্মিলিত আর্তরব।
কে কাকে কাটছে? রক্তের ফোঁটারা আমিষলোভী আমার নামে
কী যেন নালিশ করতে থাকে। নালিশ করছে কাকে?

এই তো আমার পাশেই পালঙ্কে একটি নালিশহীন মুখ ঘুমিয়ে।
এই ঘুমন্ত নারীর মুখের সাথে আমি কার তুলনা দেবো?
উপমার সব উপাদানকে তুচ্ছ করে তার নিঃশ্বাস পড়ছে।
কাঁপছে বুক। ভ্রু রেখা কুঞ্চিত হচ্ছে। তার নাকফুলে কে
উৎকীর্ণ করে দিয়েছে একটি ঘাসফুল। যে অতীত রাজ্য
থেকে সে এ শহরে বাস করতে এসেছে এ অলংকার বিন্দুটি
সেই শিশিরভেজা প্রান্তরেরই টলটলায়মান অশ্রুজল।
যা কোনদিন শুকাবে না।
এই শহরের কত খররৌদ্রকে এই মুখ শোষণ করে নিয়েছে।
গ্যাসের নীলাভ শিখা লেহন করেছে তার সর্বাঙ্গ। নিজেকে
বিদীর্ণ করে সে পৃথিবীকে দিয়েছে শিশুর কলরব।
আর পর্দার ফাঁক দিয়ে দুটি কালো চোখ মেলে দেখেছে
টেবিলে উপুড় হয়ে পড়া এক ধ্বণির বিদ্যুৎ। কবিতার
জন্মরীতির সাক্ষ্য দিতে কেউ তাকে ডাকবে না জেনেও
কী তৃপ্তি নিয়ে সে ঘুমাতে পারে। আমিতো পারি না!
আমি ততক্ষণ তাকে পাহারা দেবো যতক্ষণ আমার
গর্দানের মূল শিরার কাছে থেকে আমার প্রভু আমার
প্রার্থনার জবাব দেবেন। কারণ আমি জানি
শতাব্দীর এই শেষ পাদে
প্রেম শব্দটিকে বে-আব্রু করতে যারা টেবিল চাপড়াচ্ছে
তাদের আগ্নেয়াস্ত্রের সামনে দাঁড়াতে পারে এমন
দল বা প্রতিরোধ বাহিনী নেই। নেই
সে যৌবন যে লুণ্ঠন ও লোভের বশবর্তী নয়। নেই সেই
শিক্ষক, যিনি সৌন্দর্যের পক্ষে দাঁড়িয়ে
অন্তত একবার বিদ্রুপে বিদ্ধ হবেন।

আজ বারবার মনে পড়ছে আমি তো অস্ত্র চালনা জানতাম।
লক্ষ্যভেদ জানতাম। ঘৃণা ও ঈর্ষার আগুনে
বয়োজ্যেষ্টরা আমার হাত সেঁকে শক্ত করে দিয়েছিলেন।
মসজিদের মিনারগুলো আমাকে শিখিয়েছিলো দৃঢ়তা
আমি কেন তবে নৈঃশব্দের জন্য রাত জেগে
পৃথিবী পাহারা দেবো?
না, আক্রমণ করো প্রেমের শত্রুদের
নালিশহীন মুখের শত্রুদের।
দ্যাখো, ঐ নাকফুলটির ওপর ঘামের বিন্দুগুলো
একটি রেখা হয়ে নামছে
যেন একটি উপত্যকা বেয়ে এই মাত্র নেমে এল নদী।
আমি তার মুখের ওপর স্রোতস্বিনী জলের জানু অবলোকন করি।
আর ভাবি আমি পৃথিবীতে এসেছি সৌন্দর্যের
দেনা শোধ করবো বলে।
পৃথিবীর সমস্ত অস্ত্রবিদ্যার কসম,
কুৎসিতের জানুসন্ধিতে কুৎসাভেদী বারুদকে আমি
প্রজ্বলিত করবো।
আমার শব্দ অতিক্রম করবে তাদের হৃদপিণ্ড,
আমার উপমা উৎপাটন করবে তাদের ঈগলচক্ষু বিদ্বেষ,
তাদের কবরের মতো নাস্তিক্যের নিস্তব্ধতায় আমি বইয়ে দেব
প্রার্থনার ঘূর্নিঝড়।
আমার নিঃশ্বাসে সবুজ হয়ে উঠবে বাংলাদেশের প্রান্তর
পৃথিবীর শস্যক্ষেত্র।

কবিতাটার আবৃত্তি শুনছিলাম সাইমুম এ। আর আমিও যেনো রক্তের ভেতর অনুভব করছিলাম শহরের সর্বশেষ নিভু নিভু শব্দের মিলিয়ে যাওয়া তরঙ্গ।

ছবি কার্টেসী : গুগল 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন