নিকিতা, জাপানের একজন তরুণী। বর্তমান নাম খাওলা। ইসলামের আলোয় আলোকিত হবার পর তিনি তাঁর অনুভূতি ব্যক্ত করেন এক দীর্ঘ বক্তৃতায়। তারই সংক্ষেপিত অংশ এখানে উদ্ধৃত করা হলো :
হিজাব ও বাস্তবতা : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ
ওয়ার্ল্ড এসেম্বলি অব মুসলিম ইয়ুথ (ওয়ামী) বুক সিরিজ :২২
ইসলাম গ্রহণের পূর্বে অধিকাংশ জাপানীর ন্যায়
আমিও কোন ধর্মের অনুসারী ছিলাম না। ফ্রান্সে আমি ফরাসী সাহিত্যের উপর স্নাতক ও
স্নাতকোত্তর করার জন্য এসেছিলাম। আমার প্রিয় লেখক ও চিন্তাবিদ ছিলেন সাঁর্তে,
নিৎশে ও কামাস।
ধর্মহীন ও নাস্তিকতা প্রভাবিত হওয়া সত্ত্বেও ধর্মের
প্রতি আমার প্রবল আগ্রহ ছিল। আমার অভ্যন্তরীণ কোন প্রয়োজন নয় শুধুমাত্র জানার
আগ্রহই আমাকে এ সম্পর্কে উৎসাহী করে তোলে। মৃত্যুর পরে আমার কী হবে তা নিয়ে আমার
কোন মাথা ব্যথা ছিল না, বরং কিভাবে জীবন কাটাব এটাই ছিল আমার আগ্রহের বিষয়। আমি
শুধু সত্যকে জানতে চাইছিলাম। যদি স্রষ্টার অস্তিত্ব থাকে তাহলে তাঁর সাথে জীবন-
যাপন করব, আর যদি স্রষ্টার অস্তিত্ব
খুঁজে না পাই তাহলে নাস্তিকতার জীবন বেছে নেব এটাই আমার উদ্দেশ্য।
ইসলাম ছাড়া অন্যান্য
ধর্ম সম্পর্কে আমি পড়াশুনা করতে থাকি। ইসলাম ধর্মকে আমি ধর্তব্যের মধ্যে আনিনি। আমি
কখনো চিন্তা করিনি যে এটা পড়াশুনার যোগ্য কোন ধর্ম। আমার বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে,
ইসলাম ধর্ম হল মূর্খ ও সাধারণ মানুষদের একধরণের মূর্তিপূজার ধর্ম। কত অজ্ঞই না আমি
ছিলাম! আমি কিছু খৃষ্টানদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করি। তাদের সাথে আমি বাইবেল
অধ্যয়ন করতাম। বেশ কিছুদিন গত হওয়ার পর আমি স্রষ্টার অস্তিত্বের বাস্তবতা বুঝতে
পারলাম। কিন্তু, আমি অন্তরে স্রষ্টার অস্তিত্ব অনুভব করতে পারছিলাম না। আমি
গির্জায় গিয়ে প্রার্থনা করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু, আমি অন্তরে স্রষ্টার
অনুপস্থিতিই অনুভব করতে লাগলাম। অনেক বিষয় আমি বুঝতে বা গ্রহণ করতে পারলাম না।
আমার ধারণা ছিল ঈশ্বর যদি থাকেন তাহলে তিনি হবেন সকল মানুষের জন্য এবং সত্য ধর্ম
অবশ্যই সবার জন্য বোধগম্য ও সহজ হবে। আমি বুঝতে পারলাম না তাঁকে পেতে হলে কেন
স্বাভাবিক জীবন পরিত্যাগ করতে হবে। আমি এক অসহায় অবস্থার মধ্যে নিপতিত হলাম।
এমতাবস্থায় আমি একজন
আলজেরীয় মুসলিম মহিলার সাথে পরিচিত হলাম। তার জীবনযাত্রা ছিল একজন সত্যিকার
মুসলিমের জীবন যাত্রা থেকে অনেক দূরে। কিন্তু আল্লাহ্র প্রতি তার বিশ্বাস ছিল
খুবই তীব্র। তার জ্ঞানহীন বিশ্বাস আমাকে বিরক্ত ও উত্তেজিত করে তোলে। আমি ইসলাম
ধর্ম সম্পর্কে অধ্যয়ন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। শুরুতেই আমি কুর’আনের এক কপি
ফরাসী অনুবাদ কিনে আনি। কিন্তু আমি ২ পৃষ্ঠা ও পড়তে পারিনি, কারণ আমার কাছে তা
খুবই অদ্ভুত মনে হচ্ছিল।
আমি একা একা ইসলামকে
বোঝার চেষ্টা ছেড়ে দিলাম এবং প্যারিস মসজিদে গেলাম। সেদিন ছিল রবিবার এবং মসজিদে
মহিলাদের একটি আলোচনা চলছিল। এই প্রথম আমি ধর্মপালনকারী মুসলিমদের সাথে পরিচিত
হলাম। আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, নিজেকে তাদের মধ্যে অনেক আপন বলে মনে হচ্ছিল।
প্রত্যেক রবিবার আমি
আলোচনায় উপস্থিত হতে লাগলাম, সাথে সাথে মুসলিম বোনদের দেওয়া বইপত্র পড়তে লাগলাম।
আমার মনে হচ্ছিল, আমি সত্যের সন্ধান পেয়েছি। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হলো, সিজদারত
অবস্থায় স্রষ্টাকে আমার অত্যন্ত নিকটে বলে অনুভব করতাম।
দু বছর আগে যখন
ফ্রান্সে আমি ইসলাম গ্রহণ করি তখন মুসলিম স্কুল ছাত্রীদের ওড়না দিয়ে মাথা ঢাকা
নিয়ে ফরাসীদের বিতর্ক তুঙ্গে উঠেছে। আমার বুঝতে খুব কষ্ট হত, মুসলিম স্কুল ছাত্রীদের মাথায় ওড়না রাখার মত
সামান্য একটি বিষয় নিয়ে ফরাসীরা এত অস্থির কেন? তাদের কেউ কেউ
মনে করে, যে সকল মহিলা পর্দা মেনে চলে বা চলতে আগ্রহী তারা মূলত প্রচলিত প্রথার দাসত্ব
করেন। তাদের মধ্যে যদি নারীমুক্তি আন্দোলন ও স্বাধীন চিন্তার আহবান সঞ্চারিত করা
যায় তাহলে তারা পর্দাপ্রথা পরিত্যাগ করবে।
এ ধরণের উদ্ভট ও বাজে চিন্তা শুধু তারাই করে যাদের ইসলাম সম্পর্কে ধারণা
খুবই সীমাবদ্ধ। ধর্মনিরপেক্ষ ও ধর্মবিরোধী চিন্তাধারা তাদের মনমগজ এমনভাবে অধিকার
করে নিয়েছে যে তারা ইসলামের সার্বজনীনতা ও সর্বকালীনতা বুঝতে একেবারেই অক্ষম।
ইসলামী পোশাক বা হিজাবে আমি নিজেকে নতুন ব্যক্তিত্বে অনুভব করলাম।
আমার মনে হল, আমি পবিত্র ও পরিশুদ্ধ হয়েছি, আমি সংরক্ষিত হয়েছি। আমি অনুভব করতে লাগলাম
আল্লাহ্ আমার সঙ্গে রয়েছেন। একজন পুলিশ যেমন ইউনিফরম পরিহিত অবস্থায় তাঁর দায়িত্ব
সম্পর্কে অধিক সচেতন থাকেন, তেমনি পর্দার মধ্যে আমি একজন মুসলিম হিসেবে নিজেকে
বেশী অনুভব করতে লাগলাম।
ইসলাম গ্রহণের দু’সপ্তাহ
পর আমি জাপান চলে আসি। ফরাসী সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। উপরন্তু আরবি
শেখার প্রতি আগ্রহ অনুভব করতে লাগলাম। এ আগ্রহ আমার মধ্যে প্রবল হয়ে উঠল। অবশেষে
আমি মিশরের রাজধানী কায়রোতে পাড়ি জমালাম।
খিমার বা ওড়না পরা
বোনদেরকে সত্যিই অপূর্ব দেখাতো। আমার এক মিশরীয় বোন আমাকে বললেন আমি যেন জাপান
ফিরে গিয়েও এই পোশাক ব্যবহার করি। কিন্তু আমার ধারণা ছিল, যদি এ ধরণের পোশাক পরে
জাপানের রাস্তায় বেরোই তাহলে মানুষ আমাকে অভদ্র ও অস্বাভাবিক ভাববে যদিও আমি আমার
নতুন পোশাক কে ভালবেসে ফেলেছি। এ পোশাক পরার উদ্দেশ্যে আমি জাপানে ফেরার কয়েকদিন
আগে হালকা রঙের ঐ জাতীয় কিছু পোশাক এবং কিছু সাদা খিমার তৈরি করলাম।
আমার সাদা খিমারের
ব্যাপারে জাপানীদের প্রতিক্রিয়া ছিল আমার ধারনার চেয়ে ভাল। একবার ট্রেনে যেতে আমার
পাশে বসলেন এক আধবয়সী ভদ্রলোক। কেন আমি এরকম অদ্ভুত ফ্যাশনের পোশাক পরেছি তা তিনি
জানতে চাইলেন। আমি তাকে বললাম, আমি একজন মুসলিম। ইসলাম ধর্মে মেয়েদেরকে নির্দেশ
দেয়া হয়েছে , তারা যেন তাদের দেহ ও সৌন্দর্য আবৃত করে রাখে। কারণ তাদের সাজসজ্জা ও
অনাবৃত সৌন্দর্য পুরুষদের জন্য সমস্যা তৈরী করে। তাই, নারীদের উচিত নয় দেহ ও
সৌন্দর্য প্রদর্শন করে সমস্যার সৃষ্টি করা।
মনে হল আমার ব্যাখ্যায়
তিনি প্রভাবিত হলেন। নামার সময় আমাকে ধন্যবাদ
দিয়ে নেমে গেলেন এবং বলে গেলেন তার ঐকান্তিক ইচ্ছা ছিল ইসলাম সম্পর্কে আরো জানার,
কিন্তু সময়ের অভাবে পারলেন না।
আপনি যদি কোন কিছু লুকিয়ে রাখেন তাহলে তার মূল্য বেড়ে যাবে। নারীর শরীর
আবৃত রাখলে তার মর্যাদা বেড়ে যায়, এমনকি অন্য নারীর চোখেও তা অধিকতর আকর্ষণীয় হয়ে
উঠে। যখন কোন মানুষ লজ্জার অনুভূতি হারিয়ে
ফেলে, তখন সে পশুর সমান হয়ে যায়। আমার ধারণা, লজ্জার অনুভূতি থেকেই সভ্যতার শুরু।
কেবলমাত্র পুরুষদের
প্রতি মানবিক আবেদন জানিয়ে এবং তাদেরকে আত্মনিয়ন্ত্রণের আহবান জানিয়ে আমরা
সম্ভ্রমহানি ও অত্যাচারের এ সমস্যার সমাধান আশা করতে পারি না। একজন পুরুষ নারীর
পরিধানের মিনি-স্কার্টের অর্থ এরূপ করতে পারে : “তুমি চাইলে আমাকে পেতে পারো।”
অপরদিকে ইসলামী হিজাব পরিস্কারভাবে জানিয়ে দেয় : “আমি তোমার জন্য নিষিদ্ধ।”
তথ্যসূত্র :হিজাব ও বাস্তবতা : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন